ঢাকা,বৃহস্পতিবার, ৯ মে ২০২৪

চট্টগ্রামের হুন্ডি বাণিজ্য ২০০ ব্যবসায়ীর নিয়ন্ত্রণে

চট্রগ্রাম প্রতিনিধি :: বেপরোয়া হয়ে উঠেছে হুন্ডি সিন্ডিকেট। সোনা ও ইয়াবা চোরাচালানের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে হুন্ডির বাণিজ্য। প্রতি বছর হুন্ডির মাধ্যমে কী পরিমাণ অর্থ বিদেশে পাচার হচ্ছে, তার সঠিক তথ্য নেই কারো কাছে। কারা কীভাবে হুন্ডি করছে সে তথ্যও জানে না সংশ্ল্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যমতে, দেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে পাচার হচ্ছে। দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে হুন্ডি ব্যবসা। পাশাপাশি হুন্ডির মাধ্যমে আসা টাকা হস্তান্তরের সময় ঘটছে ছিনতাইও। তবে এগুলোর বেশির ভাগই অজানা থেকে যায়। ছিনতাইয়ে সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি পুলিশেরও জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, ২০০ ব্যবসায়ী প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে নিয়ন্ত্রণ করছেন চট্টগ্রামের হুন্ডি বাণিজ্য। কার্যক্রম চলছে স্থানীয় ও অবাঙালি দুই গ্রুপে বিভক্ত হয়ে। ব্যবসায়িক প্রাণকেন্দ্র চাকতাই-খাতুনগঞ্জ, রিয়াজউদ্দিন বাজার, হাজারীগলিই বাণিজ্যের অন্যতম স্থান। চট্টগ্রামে প্রবাসীদের পাঠানো টাকার প্রায় ৬০ ভাগই আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। মধ্যপ্রাচ্য থেকে আসছে বেশি টাকা। একাধিক গোয়েন্দা সূত্রে এ তথ্য পাওয়া গেছে। অভিযোগ রয়েছে, প্রশাসনের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় অবৈধ এ ব্যবসা এখন ওপেন সিক্রেট। তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের সহযোগিতার কথা অস্বীকার করা হয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের সহকারি কমিশনার মো. এ কে এম মহিউদ্দিন সেলিম বলেন, ঊর্ধ্বতন মহল থেকে নির্দেশ অনুযায়ী প্রমাণ পেলেই আমরা অভিযান চালাই। তবে সিএমপির অপর এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, পুলিশ প্রশাসনের বিভিন্ন শাখার অঘোষিত ক্যাশিয়াররা হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে মাসোহারা নেন। ক্যাশিয়ার চক্রটি সংশ্ল্লিষ্ট থানা পুলিশের নামে ৫০ হাজার থেকে দুই লাখ, নগর গোয়েন্দাদের নামে ২৫ থেকে ৮০ হাজার ও সিআইডির নামে ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা চাঁদা আদায় করে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, অবাঙালি গ্রুপ আমদানি-রপ্তানি, ইনডেন্টিং ব্যবসা, ট্রাভেল এজেন্সি, ক্রোকারিজ, পুরনো কাপড়, মসুর ডালসহ নানা পণ্যের আমদানিকারক সেজে আড়ালে পরিচালনা করছে হুন্ডি ব্যবসা। বিদেশে পাচার করছে শত শত কোটি টাকা। আমদানি-রপ্তানিকারক ও ইনডেন্টরদের একশ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী চক্র আন্ডার ইনভয়েস করে পণ্যের এলসি করে। এসব এলসির বিপরীতে যে পরিমাণ টাকা বিদেশে প্রয়োজন তা তাদের মাধ্যমে পাচার করা হয়। তারা সংঘবদ্ধভাবে চোরাকারবারের মাধ্যমে মিথ্যা ঘোষণায় বিভিন্ন আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যও নিয়ে আসে। স্থানীয় চক্রটি সিন্ডিকেট, উপ-সিন্ডিকেট করে বিভিন্ন দেশে থাকা বাঙালি প্রবাসীদের কাছ থেকে হুন্ডির জন্য টাকা সংগ্রহ করে। ওই টাকা বিভিন্ন চোরাচালানের ব্যবসায় বিনিয়োগ করে, যার বিনিময়ে চোরাইভাবে দেশে আসছে স্বর্ণ ও অস্ত্রসহ নানা আমদানি নিষিদ্ধ পণ্যসামগ্রী। আবার এসব টাকা থেকে আন্ডার ইনভয়েসে পণ্য আমদানির অতিরিক্ত টাকাও পরিশোধ করে অনেকে। এতে সরকার হারাচ্ছে শত শত কোটি টাকার রাজস্ব।

সূত্র আরো জানায়, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ যেসব দেশ থেকে সোনার বড় বড় চালান আমদানি করা হয়, সেখানে কেবল হুন্ডির মাধ্যমেই কোটি কোটি টাকা পাঠানো সম্ভব হয়। এ ক্ষেত্রে দুবাইয়ের সোনার মার্কেটেই গড়ে উঠেছে বাংলাদেশি হুন্ডি চক্রের সচল বাণিজ্য। একইভাবে ইয়াবার চালান আমদানির বিনিময়ে মিয়ানমারে হুন্ডির মাধ্যমে পাঠানো হচ্ছে টাকা। আবার মধ্যপ্রাচ্যের আরব আমিরাত, দুবাই, ওমান, সৌদি আরব, কাতার, কুয়েত, বাহরাইন, মালয়েশিয়াসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে প্রবাসী বাংলাদেশীদের অনেকে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাঠান। এদের মধ্যে অনেকে আবার অবৈধভাবে কর্মরত থাকায় তারা বৈধ কাগজপত্রের অভাবে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে টাকা পাঠাতে পারেন না। ফলে তারা দেশে পরিবার-পরিজনের কাছে হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বাধ্য হয়ে টাকা পাঠিয়ে থাকেন।

চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, নগরীর নিউমার্কেট ও রিয়াজউদ্দিন বাজারকেন্দ্রিক কমপক্ষে ৩০ ব্যবসায়ী মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনতে অর্থ বিনিয়োগ করছে। ইয়াবার জন্য তারা হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে টাকা পাঠাচ্ছে বলে তথ্য পেয়েছে পুলিশ। আনোয়ারা কেন্দ্রিক ১২টি ইয়াবা সিন্ডিকেটের মধ্যে কয়েকটির সঙ্গে নিউমার্কেট-রিয়াজউদ্দিন বাজারের হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ীর যোগসাজশের তথ্যপ্রমাণ আছে। তথাকথিত কিছু ব্যবসায়ী আছে যারা রিয়াজউদ্দিন বাজার ও নিউমার্কেট কেন্দ্রিক। তারা ব্যবসার আড়ালে মূলত ইয়াবা ব্যবসা করে। তারা অর্থটা এখান থেকে দেয় আর হুন্ডির মাধ্যমে মিয়ানমারে পাচার হয়। অনেক সময় মিয়ানমার থেকে সরাসরি ইয়াবা আসে আনোয়ারায়। আর টাকাটা হুন্ডির মাধ্যমে পৌঁছে যায়।

হুন্ডির মাধ্যমে একটি ফোনেই দ্রুত নগদ টাকা পাওয়ার নিশ্চয়তা এবং টাকা পাঠানোর খরচও অপেক্ষাকৃত কম হওয়ার কারণে হুন্ডির মাধ্যমে টাকা লেনদেনের দিকে ঝুঁকেন প্রবাসীরা। এর কৌশলটির মূল ব্যবসায়ী হল প্রবাসী। সে বিভিন্ন মাধ্যমে বাংলাদেশীদের জানিয়ে দেয় যে, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে যে কোনো এমাউন্ট টাকা সে প্রবাসীদের বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিবে। যেসব প্রবাসীদের বাড়িতে টাকা পাঠানো জরুরি তারা ঐ হুন্ডি ব্যবসায়ীর সাথে যোগাযোগ করে। হুন্ডি ব্যবসায়ী নির্ধারিত ফি-এর বিনিময়ে তা পাঠানোর ব্যবস্থা করে। হুন্ডি ব্যবসায়ী তার দেশীয় বিনিয়োগকারীদের সাথে যোগাযোগ করে এবং সে তার বিলিকরণ কর্মীকে এসএমএস-এর মাধ্যমে ক্রেতাদের ফোন নম্বর উল্ল্লেখ পূর্বক কাকে কত টাকা দিতে হবে জানিয়ে দেয় এবং তার কাছে কোথায় কে টাকা দিয়ে যাবে /সে টাকাটা কোথা হতে সংগ্রহ করবে তাও বলে দেয়। বিলিকরণ কর্মী ঐ টাকা সংগ্রহ করে এসএমএস-এর মাধ্যমে উল্লেখ করে দেওয়া ফোন নাম্বারে ফোন করে টাকাটা নির্ধারিত সময়ে প্রবাসীদের বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে আসে। পুলিশের তালিকায় বেশ কিছু হুন্ডি ব্যবসায়ীর নাম থাকলেও তারা রহস্যজনক কারণে থেকে যায় ধরাছোঁয়ার বাইরে।দৈনিক আজাদী

পাঠকের মতামত: